আজ : শুক্রবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

(পর্ব-৩) রাজবাড়ীর মিজানপুর ইউনিয়নে ৪০ দিনের কর্মসুচির ৯ প্রকল্পে হরিলুট ! জেনেও নিরব প্রশাসন


প্রতিবেদক
জনতার মেইল.ডটকম

প্রকাশিত: ৩:১৮ অপরাহ্ণ ,২০ মে, ২০২১ | আপডেট: ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ ,২৬ মে, ২০২১
(পর্ব-৩) রাজবাড়ীর মিজানপুর ইউনিয়নে ৪০ দিনের কর্মসুচির ৯ প্রকল্পে হরিলুট ! জেনেও নিরব প্রশাসন

বিধান কুমার।।  ৪০দিনের কর্মসূচি প্রকল্পের কাগজ পত্রে ২৮,৩২,৩৬,৪২ ও ৪৪ জন জনবল দেখিয়ে মাঠ পর্যায়ে ১৮, ২০, ২২ ও ২৬ জন শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ‘হরিলুট’ করে যাচ্ছে পি.আই.ওর সঙ্গে যোগসাজশে রাজবাড়ী জেলা সদরের মিজানপুর ইউনিয়নের দূর্ণীতিবাজ চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা।

গত ১৩/০৪/২০২১ইং তারিখে “মিজানপুর ইউনিয়নে নামে-বেনামে প্রকল্প দেখিয়ে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা আত্মসাৎ(পর্ব-১)” শিরোনামে জনতার মেইলে প্রকাশের পর অবগতি করা হলেও প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিচ্ছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তারা। না-কি দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের সাথে ভাগ-বাটোয়ারায় জড়িত? এমন প্রশ্ন থেকে যায় জনমনে।

অনুসন্ধানকালে, মিজানপুর ইউনিয়ন পরিষদের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি (টি.আর), কাবিখা-কাবিটা, ৪০ দিনের কর্মসুচি ও এল.জি.এস.পি-৩, পিবিজি, জিওবি, বিবিজিসহ সকল প্রকার প্রকল্পের মধ্যে নানা প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করে টাকা উত্তোলন করে ১৬-১৭ অর্থ বছর হতে ২০-২১ অর্থ বছর পর্যন্ত প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া যায়। ৪০ দিনের কর্মসূচিতে কাগজে-কলমে ৩২, ৩৮, ৪০, ৪২ জন জনবল দেখিয়ে মাঠ পর্যায়ে ১৮, ২০, ২২, ২৬ জন জনবল দিয়ে কাজ করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছে মিজানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিয়ার সহ সংরক্ষিত আসনের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা। এছাড়াও, সরকারি খাঁস জমি বন্দবস্ত, ভিজিএফ, ভিজিডি-ভিজিপি চাউলের কার্ড, বয়স্ক, প্রতিবন্ধি, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধিদের উপবৃত্তি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, হিজরা ভাতা সহ সকল কাজেই অনিয়ম-দূর্ণীতির সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জরিত ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান ও মেম্বারা। বয়স্ক ভাতা কার্ড সহ সকল প্রকার কার্ড করার জন্য চেয়ারম্যানের যোগসাজশে কয়েকটি ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীদের নিকট হতে মেম্বারদের অর্থ আদায়ের সত্যতা পাওয়া যায়। বয়স্ক ভাতা কার্ড করতে হলে পুরুষের বয়স হতে হবে ৬৫ বছর আর মহিলাদের হতে হবে ৬২ বছর। কিন্তু ৫০ হতে ৬০ বছর বয়সীদেরকেও কার্ড করে দিয়েছেন, প্রতিটি কার্ড করে দেওয়া বাবদ নিয়েছেন ৪/৫ হাজার টাকা।

মিজানপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু লোকের সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান- আমরা যদি কখনও চেয়ারম্যানের কাছে কোন কিছুর জন্য যাই, চেয়ারম্যান আমাদেরকে বলেন, বর্তমান দল ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ। আর আমি বিএনপি থেকে চেয়ারম্যান হয়েছি। এ কারণে আমার পরিষদে সকল ধরনের বরাদ্দ খুবই কম। তাই আমি তোমাদেরকে কিছু দিতে পারলাম না। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে করোনাকালীন সময়ও আমাদের মত হতদরিদ্ররা তেমন কিছু পায়নি। এরকম চেয়ারম্যান থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।যে চেয়রম্যান সরকারি গাছ প্রজন্ত বিক্রি করে খায়।

গত ১৩.০৪.২১ তারিখ হতে ২৫.০৪.২১ তারিখ পর্যন্ত ৪০ দিনের কর্মসূচির কাজ সরোজমিন পরিদর্শনে কয়েকবার গেলে, দেখা যায়–

১ নং ওয়ার্ডের বাদশা মেম্বার ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রকল্পের পিআইসি হয়ে নাজিমুদ্দির বাড়ী হতে জামাল মন্ডলের বাড়ি পর্যন্ত মহাদেবপুরে ৪২ জন জনবল দেখিয়ে কাজ করাচ্ছে ২০ জন জনবল দিয়ে। গত ১৩.০৪.২১ তারিখে ও ২৫.০৪.২১ তারিখে ১৯ জন ও ২০ জন কাজ করছে। হাজিরা খাতা দেখতে চাইলে সরদার আব্বাস ফকির জানান, আমাদের কাছে নাই। কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আর বলেন, ৪২ জন দিয়ে কাজ করার কথা কিন্তু ১৮-২০ কাজ করে। বাকিরা আসে না। কর্মসুচির শ্রমিক আছিয়া জানান, আমরা ৪০ দিনে মাত্র ৮ হাজার পাই, তার মধ্যে মেম্বারের ২ শত দিতে হয় আবার অসুস্থতার জন্য কামাই দিলে সে টাকাও মেম্বার খায়।

২নং ওয়ার্ডে কাগজ-কলমে ৪২ জন জনবল দেখিয়ে, মিন্টু মেম্বার মাঠে কাজ করাচ্ছে ২৪ জন দিয়ে। সেখানেও হাজিরা খাতা দেখতে চাইলে নানা অজুহাত দেখান সর্দার এবং মেম্বার। সর্দার আদ্বুল মোতালেব বলেন, আমার ২৮ জন জনবল নিয়ে কাজ করাচ্ছি তার মধ্যে ২৬ জন আছে। ৩ দিনের চিত্র যথাক্রমে ২৬, ২২, ২৩ জন আছে। অতিরিক্ত ১৬ জনের কথা জানিনা। তবে এই টাকার মধ্যে ২ টা লেবারের টাকা দলিয় ফাও আর বাকি সব মেম্বার চেয়ারম্যান খায়। মহিলা শ্রমিক কাজলি জানান, আগে আমাদের টাকা কেটে রাখতো এখন রাখে না।

৩নং ওয়ার্ডে মাষ্টার রুলে ৩৮ জন জনবল দেখিয়ে মোস্তফা মেম্বার ৪০ দিনের কর্মসূচির কাজ করে যাচ্ছেন মাত্র ১৮ জন জনবল দিয়ে। ৩ দিনের চিত্রে যথাক্রমে ১৮, ১৭, ১৭ জন শ্রমিক পাওয়া যায়। এবং মাটি কেনার কথা বলে কিছু ব্যাক্তির নিকট হতে ৪/৫ হাজার করে টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন। এ খানেও হাজিরা খাতা পাওয়া যায় নাই। হাজিরা খাতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি (মোস্তফা মেম্বার) জানান হাজিরা খাতা নাই এবং দেখাতে পারবো ন। টাকা নেওয়ার বিষয়ে আনসার সিকদার বলেন, মাটি কেনার কথা বলে আমার নিকট থেকে শফিকের মাধ্যমে মোস্তফা মেম্বার ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন।

০৪নং ওয়ার্ডে দেলোয়ার মেম্বার কাজ করাচ্ছে ৩ দিনের চিত্রে যথাক্রমে ২৬, ২২, ২৫ জন শ্রমিক দিয়ে। হাজিরা খাতা দেখতে চাইলে নানান তাল বাহানা দেখান মেম্বার দেলোয়ার। এ ব্যাপারে মেম্বারের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ৩৮ জন জনগণের তালিকা দেওয়া আছে, জন সংকটের কারণে ২৬ জন দিয়ে কাজ করাচ্ছি।

কাজের সর্দার শুকুর আলী জানান- হাজিরাখাতা থাকে ফিরোজের নিকট, কাজ হয়ে যাওয়ার পর, তাদের ইচ্ছামত একদিনে সব সই করিয়ে নেন।

০৫ নং ওয়ার্ডের জহির মেম্বার কাজ করাচ্ছেন ২০ জন জনবল দিয়ে। সরদার মিন্টু মোল্লা জানান, লিস্টে আছে ৩৪ জন। বাকি ১৪ জন জনবলের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান জানি না।

০৬ নং ওয়ার্ডের কোরবান মেম্বার ৪০ দিনের কর্মসুচির কাজ করান ঈদগাহে, ২২ জন জনবল দিয়ে। মেম্বারের অনুপস্থিত থাকায় সরদার নায়েব আলির নিকট কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি উচ্চস্বরে গালিগালাজ করে বলেন, আপনাদের তদারকির দরকার কি?? সরকারি কাজ সরকার বুঝবে। ভাল চাইলে এখান থেকে কেটে পড়েন, আপনাদের কাজ আপনারা করেন।

০৭-০৮ নং ওয়ার্ডেও একই চিত্র দেখা যায়। শ্রমিকরা জানান আমাদের যেভাবে কাজ করার কথা বলে আমরা সে ভাবেই কাজ করি। আর মেম্বারের জন্য আমরা খুশি হয়ে ২ শত টাকা করে দেই

এ বিষয়ে, রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ বা কাজের তদারকির যেনো কোনো বালাই নেই। রাজবাড়ী সদর উপজেলার পি.আই.ওর দপ্তরে আর্থিক যোগসাজশের কারণে শুধু ৪০ দিনের কর্মসূচিই নয় সকল প্রকার প্রকল্পের কাজ নয়-ছয় করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজরা।

এ বিষয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহি অফিসার, পি,আই,ও, সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার কাজের অনিয়ম সম্পর্কে জানালেও এখন তরি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে, কথা বলার জন্য ১৭/৪/২০২১ইং তারিখে বিকেল ৫ টা ১৩ মিনিটে সাব-এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বিজয় কুমারকে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নাই।

উল্লেখ্য, সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন ও জেলা প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মিজানপুর ইউপি’র দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতি করার সুযোগ পায় কি-ভাবে? প্রশ্ন রেখে গেলাম সচেতন জনসাধারনের কাছে।  (চলবে…)

Comments

comments