দেড় বছর গাইনী ডাক্তার শুন্য রাজবাড়ী ম্যাটারনিটি! সেবা থেকে বঞ্চিত গরীব মা’য়েরা
প্রকাশিত: ১২:০৩ অপরাহ্ণ ,২২ জুলাই, ২০২২ | আপডেট: ১২:১১ অপরাহ্ণ ,২৪ জুলাই, ২০২২
স্টাফ রিপোর্টার।। জেলার গরীব গর্ভবতী মা’য়েদের একমাত্র সরকারী হাসপাতাল “রাজবাড়ী মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র”(ম্যাটারনিটি) তে প্রায় দেড় বছর যাবৎ গাইনী ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রসূতি রোগীরা। গরীবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাত- গাইনী চিকিতস্যক ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর- বদলী হন গত ২০২১ সালের ৩ মার্চে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১৭ মাস ধরে গাইনী ডাক্তার শুন্য “রাজবাড়ী মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র”।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন- রাজবাড়ী জেলা শহরের বেড়াডাঙ্গা ৩নং রোডে অবস্থিত দ্বিতল তলা বিশিষ্ট “রাজবাড়ী মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র’টিতে রয়েছে উন্নত অপারেশন থিয়েটার। উন্নত ১০বেড বিশিষ্ট আলাদা ২টি রুম ও রোগীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে টিভি’র ব্যাবস্থা। আলাদা ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারসহ সকল অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থা। গর্ভবতী রোগীদের বিনা মূল্যে অপারেশন ও ঔষদ সরবারহ সহ রয়েছে সকল সুবিধা।
গরীবের ডাক্তার খ্যাত- গাইনী চিকিতস্যক ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর বদলির পর দীর্ঘদিন যাবত রাজবাড়ীর ম্যাটারর্নিটিতে মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) না থাকায় জরুরী প্রসূতি সেবা বন্ধ রয়েছে। গর্ভবতী মায়েরা স্বাভাবিক প্রসবসেবা গ্রহনের জন্যও আসছেন না ম্যাটারর্নিটিতে। আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১শ থেকে দেড়শ গর্ভবতীকে এএনসি পিএনসি প্রদান করা হতো। মাসে যেখানে ৫০ থেকে ১শ রোগী সিজার হতো, এক/দেড়শ নরমাল ডেলিভারি হতো। আজ সেখানে ৫ থেকে ১০ জনের সেবা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছেনা। রাজবাড়ী জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে সিএস বিএ ও পরিবার কল্যান পরিদর্শকগণ জটিল ও গর্ভবতী মায়েদের মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে রেফার করতেও পারছেন না। ফলে সম্পূর্ন জেলার মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমানে রাজবাড়ী ম্যাটারর্নিটি যেন প্রাণহীন একটা ভবন মাত্র। আগে যেখানে চিকিৎস্যক, নার্স ও রোগীতে পূর্ন থাকতো, এখন সেখানে গর্ভবতী মায়েদের সেবা নিতে দেখা যায় না। মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে গর্ভবতী রোগীদের বিনা মূল্যে অপারেশন ও ঔষদ সরবারহ সহ সকল সুবিধা থাকা স্বত্বেও গাইনী চিকিৎক না থাকায় বে-সরকারি ক্লিনিকে গিয়ে রোগীর স্বজনদের গুণতে হচ্ছে অনেক টাকা। যা একটি মধ্যবিত্ত বা গরীব রোগীর স্বজনদের জন্য আলাদা একটা বোঝা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে; গাইনী চিকিৎকের রুমের তালাবদ্ধ। ২য় তালায় যেখানে প্রসূতী রোগীদের থাকার কক্ষে বেড গুলো ফাঁকা, দীর্ঘদিন বন্ধ সিলিং ফ্যানের গোড়ায় মাকড়সার বাসা, সেখানে মনমরা হয়ে একাই বসে ছিলেন ক্লিনিকের আয়া ফিরোজা। অনেক বছর ধরে তিনি কাজ করছেন এই ম্যাটারনিটিতে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে এ প্রতিবেদককে ফিরোজা বলেন; রোগী নাই, মানুষ জন নাই, তাই ভালো লাগেনা, শুধু শুধু বসে থাকা। কবে যে ডাক্তার আসবে? কে জানে? এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে আয়া ফিরোজা বলেন; এখানে গাইনী ডক্তার না থাকায় রোগীরা আসেনা। সেদিন একজন রোগী আসছিলো, তার ৩ নম্বর বাচ্চা হবে। ডাক্তার নাই এজন্য সে চলে গেছে, কারন যদি নরমাল ডেলিভারি না হয়ে সিজার হতে হয়! যেহেতু ডাক্তারও নাই, যদি কোন সমস্যা হয়! পরে সে অন্যত্রে চলে যায়।
মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের এক ভিজিটর বলেন- সেই যে ডা. গোপাল স্যার গেলো আজ পর্যন্ত আর কোন ডাক্তার আসে নাই। ডাক্তার না থাকায় রোগীরাও আসে না। দুই/একটা যা-ই আসে, পেশার মেপে চেকাপ করে চলে যায়। চিকিৎস্যক না থাকায় নষ্ট হচ্ছে অপারেশন থিয়েটারের প্রয়োজনিয় সরঞ্জাম সহ লাখ টাকার ঔষধ।
এ বিষয়ে ১৮/০৭/২০২২ তারিখ দুপুরে সাক্ষাতে কথা হয় জেলা পরিবার পরিকল্পনার উপ পরিচালক ডা. গোলাম মোঃ আজমের সাথে। তিনি বলেন, ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর বদলীর পর থেকে চিকিৎসক শূন্যতায় রয়েছে রাজবাড়ী মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র। চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। তারপরও আমরা এফডব্লিভি দিয়ে কিছুটা কাজ চালাচ্ছি , গত মাসে ৮ জনের নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। আমরা আমাদের উর্ধতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।
দীর্ঘদিন হয়ে গেলে, অথচ গাইনী চিকিৎসক আসছেনা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে অনুসন্ধানে জানা যায়; এই মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে এমওএমসিপি ও এনেস্থিয়া অভিজ্ঞ ডাঃ নিয়ামত উল্লাহ দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে চাকরি করছেন রাজবাড়ীর এই ম্যাটারনিটিতে। তিনি শিশু রোগী দেখতেন ও এনেস্থেসিয়া দিতেন অপারেশনের (সার্জারী) রোগীদের। এনেস্থিয়া ডা. নিয়ামত উল্লাহার সাথে বদলী হওয়া গাইনি চিকিৎক ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্র ধরের সাথে কোন বনিবনা ছিলোনা। ডা. নিয়ামত উল্লাহ স্বপরিবারে ম্যাটারনিটির সরকারি কোয়ার্টারের নিচ তলায় থাকেন ও ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর থাকতেন উপর তলায়। উপর ও নিচ তলায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ছিলেন ডাঃ গোপাল সূত্রধর। গর্ভবতী রোগীদের সিজারের জন্য নিয়মিত ওটিতে আগে ঢুকতেন গাইনী ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর, অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও ওটিতে ঢুকতে প্রতিনিয়তই দেরি করতেন এনেস্থিয়া ডা. নিয়ামত উল্লাহ। যে কারনে প্রতিনিয়তই ফোন করে ডেকে আনতে হতো ডা. নিয়ামত উল্লাহকে। ডা. গোপাল চন্দ্র সূত্রধর তাকে জিঙ্গেস করতেন ওটিতে আসতে এত দেরি হয় কেন? এনেস্থিয়া ডা. তখন না-কি বিভিন্ন অজুতাতে বাইরে ছিলেন, সে কারনে আসতে দেরি হয়েছে। তথচ তিনি নাকি বাসায় শুয়ে ছিলেন। তার এই মিথ্যে কথা ধরতেই সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন ডাঃ গোপাল সূত্রধর। একদিকে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কারনে সমস্যা, আরেকদিকে প্রতিনিয়ত ওটিতে ফোনে ডেকে নেওয়ার কারনে মনে মনে রাগাম্বিত ছিলেন এনেস্থিয়া ডা.। চাকুরিতে থাকা কালীন ম্যাটারনিটির গাইনি ডাঃ গোপাল সূত্রধর ছুটিতে ভারতে বেড়াতে গেলে, সেই সুজোগে গোপাল সূত্র ধরের রুমের সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলেন ডাঃ নিয়ামত উল্লাহ। তারপর আবার স্থানীয় মাস্তানরাও হুমকি-ধামকি প্রদান করা হয়েছিল ডাঃ গোপাল সূত্রধরকে । সে ঘটনায় রাজবাড়ী থানায় জিডি করেছিলেন ডাঃ গোপাল সূত্রধর। ততকালীন কোন অদৃশ্য শক্তি প্রভাব খাটিয়ে বদলীসহ বিভিন্ন ভাবে তাকে হয়রানি করেছেন বলেও বিশ্বস্তসূত্রে জানাযায়। আরও জানাযায়, ডাঃ গোপাল সূত্রধরের বদলীর পরপরই এফএমএ শামীমাকে বদলী করা হয়। এই শামিমার সাথেও মনমালিন্য ছিল ডা. নিয়ামত উল্লাহার। পরে ডাঃ গোপাল সূত্রধর বদলী হলে রাজবাড়ী মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে এ পর্যন্ত আর কোন গাইনী ডাক্তার আসে নাই। যার কারনে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ গর্ভবতী মা’য়েরা। অপরদিকে, এখানে চাকুরিরত ১০/১২ জন স্টাফদের অকারনে বেতন দেওয়ায় গচ্ছা যাচ্ছে সরকারের লাখ লাখ টাকা। বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই। প্রশ্ন হলো; এভাবে চলবে আর কত দিন?
প্রকাশ থাকে যে, ৩১ অক্টোবর-১৯ বৃহস্পতিবার বেলা ৩.টার দিকে রাজবাড়ী মা ও কল্যান কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়- ডা.গোপাল চন্দ্র সূত্রধর প্রস্তুত হয়ে সিজারের রুগীকে বসিয়ে রেখে অপারেশন থিয়েটারের মধ্য ছটফট করছেন আর বলছেন, অ্যানেস্থাসিয়া ডা.নিয়ামত উল্ল্যাহ কে আবারো ফোন করেন। উনি বাসায় বসে কি করছেন?