রাজবাড়ীতে যত্রতত্র ডিজে সাউন্ড বক্স! জনজীবন অতিষ্ঠ; নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
প্রকাশিত: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ ,১ জানুয়ারি, ২০২০ | আপডেট: ৪:০৪ অপরাহ্ণ ,১ জানুয়ারি, ২০২০
নিজস্ব প্রতিবেদক।। সভ্য সমাজ গড়তে দেশে শিক্ষিতর হার বাড়িয়েও আমরা আজ সভ্য হতে পারি নি। নিজেকে সভ্যতার খোলসে আবৃত করে বারবার শুধু অসভ্য প্রমান করে গেছি। কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটলে এমনটা করতে পারি তার হিসেব হয়তো কারো জানা নেই। মানুষকে মানুষ না ভেবে যে কোন অনুষ্ঠান হলেই আমরা সারা রাত ডিজে সাউন্ড বক্স/মাইক বাজিয়ে থাকি।
শব্দ দূষণ এখন জীবনবিনাশী শব্দ সন্ত্রাস। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই এর বিরুদ্ধে। ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়, হৃদযন্ত্রের কম্পন ও রক্তচাপ বেড়ে যায়, হজমক্রিয়া ব্যাহত ও মাংসপেশীতে খিঁচুনি হয়, শিশুদের বেড়ে ওঠায় বাধাগ্রস্ত এবং গর্ভবতী নারীদের মৃত সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। শব্দ দূষণে মেজাজ খিটখিটে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয়। অসুস্থরা এই শব্দ দূষণের বড় শিকার। আমাদের শরীর, মস্তিস্ক ও মন সবকিছুর উপরেই শব্দ দূষণের প্রভাব রয়েছে। এটি উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ (বিভিন্ন অসুখের মূল কারণ), শ্রবণশক্তি হারানো, ঘুমের বৈকল্য ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দ দূষণজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রচন্ড মাথাব্যাথা, বিরক্তিভাব, আতঙ্কভাব, অবসাদবোধ এবং কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়া উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও কোন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে রাতভর অসংখ্য মাইক বাজানো এবং উত্সবের নামে দিন-রাত সাউন্ড সিষ্টেম বাজিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দেন বিবেক শূণ্যতার সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাশে মুমূর্ষু রোগীর আত্মচিত্কার, পরীক্ষার্থীদের পড়াশুনা, কারোর নাম জপায় ব্যস্ততা এসব যেন কোন আয়োজকদের মাথায় থাকে না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপবাদের ভয়ে প্রতিবাদকারীরা ও টুপ শব্দ টুকু করার সাহস পাচ্ছে না।উন্নত সাউন্ড সিস্টেমের অপব্যবহারে আশে-পাশের লোকজন ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। সচেতন একজন বাবা দিতে পারেন না তার সন্তানকে পড়াশুনা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। মুমূর্ষু রোগীর পাশে থাকা আত্মীয়-স্বজনেরা দিতে পারেন না মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া কাছের মানুষটিকে একটু প্রশান্তি । হাই এ্যাম্পেয়ার সাউন্ড-বক্স হচ্ছে শব্দ দুষণ যন্ত্র। এর বিকট শব্দে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শব্দও যন্ত্রণাদায়ক। বিশেষ করে হার্ড দূর্বল মানুষের জন্য তো চড়মভাবে খতিকর। এর শব্দে হার্ডবিট বেরে যেয়ে হার্ড দূর্বল মানুষ অসুস্থ হয়ে মারাও যেতে পারে। আবার সুস্থ মানুষও অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
গতকালকের কথা বলছি, বছরের প্রথম দিন হিসাবে থার্টি ফাস্ট উপলক্ষ্যে- আমার রাজবাড়ী শহরের পাড়া/মহল্লায় অনুষ্ঠান চলছিল সারারাত জুড়ে। আশপাশের এলাকার মানুষের ঘুম নেই । আমিও এর শিকার হয়েছিলাম। রাতে ঘুম না হওয়ায় অসহ্য যন্ত্রনায় আমি সকাল ৮.টার দিকে আমার ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, “বেহায়া অভিভাবকের নির্লজ্জ ছেলরা আর যুগের জারজ সন্তানরা, ২০১৯ সালের রাত হতে ২০২০ সালের এখন সকাল পর্যন্ত সাউন্ড বক্স বাজাইতেছে !”
এর আগে, থার্টি ফাস্ট এ সন্ধ্যার পর হতে উচ্চ শব্দযুক্ত সাউন্ড বক্স না বাজানো ও ডিজে পার্টি না দেওয়ার জন্য রাজবাড়ী জেলা পুলিশ প্রশাসনও বিজ্ঞপ্তি ও ঘোষণা দিয়েছিলেন। যাতে রাত ৮.টার পর মাইক/সাউন্ড বক্স বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু জেলা পুলিশ প্রশাসনের সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সারা রাত-তো চলেই সকাল ৮:৩০ মিনিট পর্যন্ত চলে ডিজে সাউন্ড বক্সের শব্দ।
ইদানীং একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিয়ে বা মুসলমানির অনুষ্ঠানওয়ালা বাড়িতেএই সাউন্ডস বক্সের যত্রতত্র ব্যাবহার। হাই শব্দযুক্ত সাউন্ড-বক্স একটা ভাড়া করে এনে আশ-পাশের বাড়ির কোন অনুমতি ছাড়াই নিজের বাড়িকে সেভ করে আর অন্যের বাড়ির দিকে মুখ করে দিয়ে উচ্চ শব্দে বাজাতে থাকে। আশ-পাশের বাড়িওয়ালাদের সমস্যা হচ্ছে কি-না সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করে না। পাশের বাড়ির কোন ভদ্রলোক যখন বিরক্তি হয়ে না বাজানোর জন্য অনুরোধ করে, তখন তার কথা না শুনে একাধারে বাজাতেই থাকে। সেই ভদ্রলোক উপায় অন্ত না পেয়ে ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য কোন ঝগরাজাটি না করে বাধ্য হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে দুরে চলে যায়।
সমাজে বিভিন্ন জন বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। যারা ভুল বসত অন্যায় করে তারা মানুষ। আর যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করে তারা আসলেই অমানুষ। মানুষ হিসাবে নিজে আনন্দ করে অপরকে কষ্ট দেওয়া বা বিরক্তো করা ঠিক না। একাধিক সাউন্ড বক্স বাজানো হয় উচ্চ শব্দে। ফলে শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে অতিষ্ঠ মানুষ। শব্দের দাপটে বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভীষণ অসুবিধা হয়। বিশেষ করে কোমলমতি শিশু, হার্ডের রুগী বা হার্ড দূর্বল মানুষদের জন্য সাউন্ড বক্সের ডিজে শব্দ ভিশন কষ্ট দায়ক ও মারাত্মক ক্ষতির কারণ। উচ্চ শব্দযুক্ত সাউন্ড-বক্সের শব্দে পরিবেশ উত্তপ্ত ও নষ্ট হয়। এই উচ্চ শব্দের বক্স বাজানোটাও কিন্তু সন্ত্রাস বা মাদক ব্যাবসার মতো অন্যায়ের সামিল। এটিও সমাজের মানুষের কোন অংশে কম ক্ষতি করে না!
এ বিষয়ে- নাক, কান, গলা বিষেজ্ঞ বলেন,- প্রায় প্রতিদিনে উচ্চ শব্দে সাউন্ড বক্স/মাইক বাজানো হচ্ছে। অনেকেই আবার সাউন্ড পেলে নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কিন্তু এ আওয়াজ, আরেকজন অসুস্থ ব্যাক্তি, যিনি এখনই নামাজ পড়ে বিছানায় যেতে চান তার নামাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, সেদিকে কারো বিন্দুমাত্র নজর নেই। ৪৫ ডিবি মাত্রার শব্দে সাধারণত একজন মানুষ ঘুমাতে পারে না। ৮৫ ডিবি মাত্রার শব্দ শ্রবণশক্তির ক্ষতি করতে শুরু করে। ১২০ ডিবি মাত্রার শব্দে কানে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। লাউড স্পিকারের শব্দ ৯০-১০০ ডিবি, আর সাউন্ড বক্সের শব্দ ১৪০/৫০ ডেসিবল (ডিবি) পর্যন্ত বা তারচেয়ে বেশী হয়ে থাকে। আমাদের শরীর, মস্তিস্ক ও মন সবকিছুর উপরেই শব্দ দূষণের প্রভাব রয়েছে। এটি উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ (বিভিন্ন অসুখের মূল কারণ), শ্রবণশক্তি হারানো, ঘুমের বৈকল্য ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দ দূষণজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রচন্ড মাথাব্যাথা, বিরক্তিভাব, আতঙ্কভাব, অবসাদবোধ এবং কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়া উল্লেখযোগ্য।
অপরদিকে- ধর্মীয় উদ্দেশ্যই হোক আর যে কোন অনুষ্ঠান উলক্ষেই হোক গভীর রাতে সাউন্ড বক্স/ মাইক বাজনো হলেও তা হিতে বিপরীত হচ্ছে। গভীর রাতে অসুস্থ মানুষের ঘুম নষ্ট করে মাইক বাজানো নৈতিকতা বিরোধী। এসব ক্ষতিকর প্রচারণা অচিরে বন্ধ করা উচিত্।
আর এখনই সময় এই শব্দসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। চারপাশে যদি এই নীরব ঘাতকের মাত্রা বেড়েই চলে তবে অচিরেই আমরা আমাদের শ্রবনশক্তি হারাবো। হয়তোবা বধির বনে যাবো। মনে রাখবেন- আপনার উল্লাস যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়।তাই মধ্যরাতে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়ে পর্যলোচনা করে রাজবাড়ী প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করবে বলে আমি আশা রাখি। অপরদিকে- পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে উচ্চ শব্দযুক্ত সাউন্ড-বক্স বাড়িতে যত্রতত্র বাজানো আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ।
আমার পরামর্শ হলোঃ-
কোন অনুষ্ঠানে যদি সাউন্ড বক্স/মাইক বাজানোর প্রয়োজন হয় তাহলে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে- আশ-পাশের বাড়িওয়ালাদের অনুমতিক্রমে নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে বাজাতে দেওয়ার সিষ্টেম চালু করা উচিৎ বা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। প্রশাসনের লিখিত অনুমতি ছাড়া উচ্চ শব্দযুক্ত সাউন্ড বক্স বাড়িতে যত্রতত্র বাজানো আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়৷ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে৷ আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না৷
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ হাসান জানান, ‘‘আইনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ আরো কিছু বিষয়ে ব্যতিক্রম আছে৷ তবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর কোনোভাবেই উচ্চ শব্দের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না৷ পুলিশের স্বপ্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে৷ আর পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে৷”