লক্ষ্মীকোলের এনায়েত বিশ্বাস বলেন, দিন তারিখ মনে নেই, একদিন তামেছ সরদারের ছেলে কুটি সরদারকে ও তার বাড়ির কামলা কাঙ্গাইল্যাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে বিহারীরা, রাজার বাড়ির উত্তর-পূর্বপাশে বছির বকসর বাড়ির নিকট কুটি সরদারকে জবাই করে হত্যা করে খাদের মধ্যে ফেলে দেয় । একই সময় কুটি সরদারের বাড়ির কামলা কাঙ্গাইল্যাকেও গুলি করে হত্যা করে পাচু বাবুর বাড়ির বাশ ঝাড়ের মধ্যে ফেলে রাখে । ধীরেন ভূইমালি ও তার ভাই হইর্যাকে লক্ষ্মীকোল গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে বিহারীরা পালপাড়া মজুমদারের বাড়িতে নিয়ে যায়, সেখানে তাদের দুই ভাইকে দিয়ে মজুমদারের বাড়ির নারকেল গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়ে সবাই খায় ।
এসময় তাদের হাতে দু’টুকরো নারকেল খেতে দিয়ে বলে বাড়ি চলে যা, সেখান থেকে ধীরেন ও হইরা দুই ভাই হেটে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই তাদের পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে, এক গুলিতেই দুই ভাই হত্যা হয় । এর কিছুদিন পর পাল পাড়ায় একই দিন সময়ে ধেইরা পাল ও নগেন পাল সহ ৭/৮ জনকে বিহারীরা গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করে । রাজারবাড়ি লুটের ২/৩ দিন পূর্বে আগুন লাগিয়ে নুরপুর কটার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল ।
এনায়েত বিশ্বাস আরো বলেন, মেলেটারীরা আসার পর বিহারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে, রাজবাড়ী বাজারের শওকত চেয়ারম্যানের দাদা নিকবার মোল্লার চাল-আটার ডিলারের দোকান, পূর্নদত্তর দোকান, নগেন পালের দোকান, ছরি শাহার দোকান, ঘন শাঁ দত্তর তেলের দোকান সহ আরো বিভিন্ন দোকানে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে বিহারীরা । তিনি বলেন আরো বলেন শুনেছি, যুদ্ধের সময় রাজবাড়ী রেল স্টেশনের কাছে রাজবাড়ী বডিংয়ে বিহারীরা থাকত, রাতের ট্রেনে আসা যাত্রী সাধারনের টাকা-পয়সা কেড়ে নিত এবং মহিলা যাত্রীদের রাজবাড়ী বডিংয়ে নিয়ে ধর্ষন করত । ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না । এ ধরনের হত্যা ও লুটপাটের পর, প্রথমদিকে পাংশার মতিন ও মতিনের চাচার নেতৃত্বে ৫০/৬০ জন লোকের একটি বাহিনী নিয়ে লক্ষ্মীকোল গ্রামের শরকত চেয়ারম্যানের বাড়িতে স্থান নেয় । শওকত ভাই ততকালিন দাদশী ইউপি চেয়ারম্যান ।
মতিন ওই এলাকার মাতবর/মান্যগন্য ব্যাক্তিদের মধ্যে গেদু বিশ্বাস, গনি মেম্বর, তারো সরদার, ধোনাই সরদার, গোলাই মেম্বর, গেদা মন্ডল সহ আরো অনেককে ডেকে এনে একটি মিটিং করে, সেই মিটিংয়ে উপস্থিত সকলকে মতিন বলে, দেশে যুদ্ধ লেগেছে, পাকিস্থানী মেলেটারীরা রাজবাড়ীতে ঢুকেছে, বিহারীদের সাথে যোগ দিয়েছে । বিহারীরা দেশের বাঙ্গালীদের বাড়িতে লুটতরাজ করে চলেছে, নারী ধর্ষন ও হত্যা শুরু করে দিয়েছে, বাঙ্গালীদের উচ্ছেদের পায়তারা করছে । ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে । পাকিস্তানী বিহারীদের এদেশ থেকে বিতারিত করতে হবে । বিহারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আপনারা এই এলাকার সাহসী যুবকদের ডেকে দিন, একটি দল গঠন করে তাদের ট্রেনিং করাবো যুদ্ধের জন্য ।
আর যদি যুদ্ধের জন্য লোকজন দিবার নাও পারেন, তাহলে শুধু আমাদের কোন রকমে খাদ্য-পানি ও থাকার জন্য একটু স্থান দেন এবং আমাদের রাস্তা-ঘাট চিনিয়ে দেন । এ কথা বলে সেদিনের মতো মিটিং শেষ করেন । তার ২/৩ দিন পরেই মতিন গ্রুপের সাথে ২৫/৩০ জন লোক নিয়ে যোগ দেন লালী নামের আরেক কমান্ডার । মতিন ও লালী গ্রুপ এই এলাকায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করে যুদ্ধ করায় ৫০শোর্ধ বয়সের লোক সকলেই তাদের চেনে ও জানে । যুদ্ধের অনেক ঘটনার মধ্যে শেষ যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ননা, মতিন গ্রুপ ২৫/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বর্তমান মোশারফের ভাটার রাস্তা দিয়ে বিহারী কলোনীতে এ্যাটাক করে ।
মতিনের চাচা ও লক্ষ্মীকোলের মুক্তিযোদ্ধা হিলাল ৩৫/৪০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে নুরপুর রাস্তা দিয়ে বিহারী কলোনী এ্যাটাক করে । লালী গ্রুপ রামচন্দ্রপুর দিয়ে রঘুনাথপুরের দিক থেকে বিহারী কলোনীতে এ্যাটাক করে । (আরেক দিকে কমান্ডার ইলিয়াছ বাহিনী ছিল সেটার বর্ননা জানা নাই)। দুই রাত দুই দিন গুলি-পাল্টা গুলি বিনিময় হয়, শত্রুদের গোলা-বারুদ ফুড়িয়ে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ৩ দিক থেকে বিহারী কলোনীর উপর ঝাপিয়ে পরে । তাৎখনিক রাগের মূহুর্তে ওই কলোনীর মধ্যেই অন্তত ৯০ ভাগ পুরুষদের হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধার । যারা জীবিত ছিল তাদের মধ্যে কিছু পুরুষ ও নারী মিলে প্রায় ৩ শতাধিক বিহারীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে শরকত চেয়াম্যানের বাড়িতে এনে সেখানে সারাদিন রাখা হয় । তাদের সাথে শিশুরাও ছিল ।
দিন শেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পর বেড়ি বাধের ওপাড়ে পদ্মা নদীর তীরে নিয়ে তাদের কিছু সংখ্যক জবো করে ও বেশীর ভাগ গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধার । এরপর বাঙ্কার কেটে নিহত বিহারীদের মটি চাপা দেওয়া হয় । বিহারীদের মেরে যে খানে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল, সে জায়গা হচ্ছে, ঝড়ু কারীর বাড়ির সামনে বাধের বাইরে নদীর তীরে, মাদু সরদার, মাদাইরে, হোসেন খাঁ, ইমান, নাইজরা কাজী, সকরা ফকীর, আজিবর, গেদা ফকীর ও হোসেন ফকীরের বাড়ীর পেছনে নদীর তীরে বিহারীদের লাশ মাটি চাঁপা দেওয়া হয় ।
এই এলাকার মুরুব্বি মানুষদের কাছে মনে হয় সেদিনের ঘটনা । ততকালীন যাহারা খুজিলদার বা রাজাকার ছিলেনঃ- রাজাকার বাবুর বড় ভাই হেদা, মসলেম গাড়োয়ানের শ্বশুর আবুল ও তার ভাই হেদা, পাঞ্জু সরদারের ছেলে মৃত ইন্তাজ সরদার, লক্ষ্মীকোল গ্রামের মৃত নেওয়াজ মোল্লা, মৃত বাউল ফকীরের ছেলে মৃত নিজাম ফকীর ওরফে নিজাম ডাকাত, মৃত মেলাই মন্ডলের ছেলে, মৃত এলেম মন্ডল, মৃত সেরো মন্ডল, মৃত ইব্রাহীম মন্ডল, নাইজদ্দি মন্ডল পিং অজ্ঞাত । এমন আরো আছে তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে ।
এ প্রতিবেদকের কিছু কথা, কারন বসত ধর্ষনের ঘটনা ও রাজারবাড়ি লুটের ঘটনার সাথে জড়িতদের মধ্যে কিছু লোককে বাদ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে । শ্রদ্ধেয় পাঠকগন, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । কাউকে হ্যায় করার জন্য নহে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানোরে উদ্দেশ্যে এ ইতিহাস প্রকাশ করা হলো । তবে যতটুকু জেনেছি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, এমন আরো অনেক ঘটনা আছে, রয়েগেছে অজানা, খুঁজে পেলে পরবর্তিতে প্রকাশ করা হবে ।