বিধান কুমার ।।রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় যৌন পল্লী এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহত যৌনপল্লী হিসাবে অবস্থিত। এই যৌনপল্লীর শিশু ও নারীদের নিয়ে কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার হলেও বাস্তবে রয়েছে কয়েক গুণ বেশী।
এসব যৌনকর্মীদের রয়েছে বিভিন্ন বয়সের শিশু সন্তান । এসব শিশুরা পিতৃপরিচয় দিতে না পারায় হচ্ছে না অন-লাইনে জন্মনিবন্ধন। তবে পল্লীর যেসব শিশুদের বাবার পরিচয় নেই তারা বাবার স্থানে অপ্রাপ্ত লিখে জন্ম নিবন্ধন করতে পারবে বলে জানায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) মোঃ মাহাবুর রহমান।
পায়াক্ট বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থার ব্যবস্থাপক মজিবুর বহমান জুয়েল, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষিত করতে এখানে বেশ কয়েকটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে। তার পরও অনেক মেয়ে শিশুই মায়েদের পেশা গ্রহন করতে বাধ্য হচ্ছে, অপরদিকে ছেলে শিশুরা বিভিন্ন অপরাধ মূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আর যে গুটিকয়ে শিশু শিক্ষিত হচ্ছে তারা পরছে নানা ভোগান্তিতে। অতীতে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুরা পিতার নামের ক্ষেত্রে যে কোন একটা নাম ব্যবহার করে মোটামুটি চালিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যাও হয়নি। বর্তমানে প্রতিটি মানুষের সঠিক জন্মনিবন্ধন অনলাইনে সংরক্ষন হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুরা। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও যৌনকমীর্ ও পল্লীর শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের মাধ্যমে অস্থায়ী অভিভাবক দিয়ে জন্মনিবন্ধন করা হচ্ছে। তবে ওইসব অস্থিায়ী অভিভাবকেরা থেকে যাচ্ছে শঙ্কার মধ্যে। কারণ তাদের ওরশজাত সন্তানদের পাশাপাশি আইন অনুযায়ী ভবিষতে জন্ম নিবন্ধন সূত্রে তাদের ওয়ারিশ হবেন ওই শিশুরা।
পায়াক্ট বাংলাদেশ সংস্থার কর্মী শেখ রাজিব বলেন, অতিতে জন্মনিবন্ধন অনলাইনে সংরক্ষন না থাকায় দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুরা তাদের বাবা নামের ক্ষেত্রে
যে কোন একটি নাম ব্যবহার করতো। কিন্তু বর্তমানে অনলাইনে সংরক্ষন হওয়ায় জন্ম নিবন্ধন করতে পারছে না। কারণ জন্ম নিবন্ধনের সময় বাবা ও মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রয়োজন পরছে। যে কারণে শিশুরা জন্ম নিবন্ধন করতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে আমার মত অনেকেই আছে ওইসব শিশুদের অভিভাবক হয়ে জন্মনিবন্ধন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই অস্থায়ী অভিভাবকের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ এই শিশুগুলো যখন বড় হবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে,বিবাহ করিবে,জায়গা জমি ক্রয় করিবে তখন কিন্তু তাদের বাবার পরিচয়পত্র দেখাতে পারবে না। তিনি আরও বলেন,আমি শঙ্কায় রয়েছি। কারণ নিজে পিতৃ পরিচয় দিয়ে অনেক শিশুর জন্মনিবন্ধন করিয়েছি। ওয়ারিশ সূত্রে ওই শিশু গুলো তার সম্পত্তির ভাগিদার হয়ে গেলো। যে কারণে তিনি আর কোন শিশুর জন্মনিবন্ধনে অভিভাবক হচ্ছে না।
ভূক্তভোগী যৌন পল্লীর কয়েকজন শিশু জানায়, তাদের জন্ম যৌনপল্লীতে। বেড়ে উঠা সেখানেই। তাদের মা থাকলেও নেই বাবার কোন পরিচয়। ফলে বর্তমানে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। কেউ কেউ জন্মনিবন্ধন করতে না পারায় স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। আবার কেউ বিদ্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ দেখাতে না পারায় লেখা পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এঅবস্থায় মেয়ে শিশুরা শঙ্কায় রয়েছে বড় হয়ে তাদের ফিরতে হবে মায়ের পেশায়। আর ছেলে শিশুরা ছিনতাই, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পরবে। তাদের দাবি জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য সরকার পদক্ষেপ নিবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩০ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তার জন্ম কোথায় জানেন না। পল্লীর এক যৌন কমীর্র কাছে বেড়ে উঠা। তাকেই মা বলে জানেন। বুদ্ধি হওয়ার পর জানতে পারে ওই যৌনকর্মী তার মা না। ফলে বাবা—মায়ের পরিচয় না থাকায় ত্রিশ বছরেও করতে পারে নাই জন্ম নিবন্ধন, নেই জাতীয় পরিচয় পত্র।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ মাহাবুর রহমানের সঙ্গে ২২ শে এপ্রিল শক্রবার বিকাল ৫ টা ২৫ মিনিটে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান ,জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর বিধিমালা ১৮ অনুসারে বলা রয়েছে যেসব শিশুদের বাবার পরিচয় নেই তারা বাবার স্থানে অপ্রাপ্য লিখে জন্ম নিবন্ধন করতে পারবে। এই আইনে যৌনপল্লির বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। তবে আমরা ঈদের পরপরই ক্যাম্পের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ইউপি সচিবকে অবহিতও করেছি। সেই সাথে বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করছে যেন সহজে যৌন পল্লীর শিশুরা তাদের জন্ম নিবন্ধন করতে পারে।
তিনি আরও জানায়, যৌনপল্লীর শিশুদের অস্থায়ী অভিভাবকের সম্পত্তি এসব শিশুরা পাবে কিনা সেটা আদলতের বিষয়। আদালতেই ব্যবস্থা নিবে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানের সঙ্গে ২২শে এপ্রিল শুক্রবার বিকাল ৫ টা ১৭ মিনিটে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, জন্ম নিবন্ধন ছাড়া ভোটার হওয়া সম্ভব নয়। জন্ম-নিবন্ধন করার কাজটা স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আর ভোটারের জন্য কাজ করে নির্বাচন কমিশন।
তিনি আরও বলেন, পূর্বে একবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আদ্বুর জব্বার পিতৃ পরিচয় দিয়েছেন অনেক শিশুর। আর বর্তমানে জারা ভোটার হতে পারছেনা তার জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। নির্দেশনা আসলেই আমরা ভোটার তালিকার কাজ হাতে নেব।